কবি আসিফ নূর সাহিত্যরথে একজন স্বপ্নসারথী
-সুব্রত আপন
কবি আসিফ নূর জন্মগ্রহণ করেছেন দরিয়ানগরখ্যাত কক্সবাজার সদরে। শিক্ষা সনদ শেষ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। মেধাবী এ কবি অত্যন্ত সচেতনচিত্তে প্রকাশ করেছেন-অপার অপেরা, খেয়ালি খেয়া, (ইংরেজি অনুবাদসহ), চোখের আলোয় দেখেছিলেন, শরবিদ্ধ স্বরের শহর, বিষকন্যা এসেছিল বেহুলার বেশে, মৃগয়াসুন্দরী কাব্যগ্রন্থগুলো। সম্পাদনা করেছেন অধ্যক্ষ স আ ম শামসুল হুদা চৌধুরী স্মারকগ্রন্থ। লিখেছেন রম্যোপন্যাস উলুবনে মুক্তা।
আমি আসিফ ভাইয়ের সৃষ্টির একজন পাঠক। কক্সবাজারের যে ক’জন কবি ভালো লিখেন তার মধ্যে আলোচিত কবি আসিফ নূর। পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। তাঁর কবিতায় বিনির্মাণ করেছেন প্রকৃতি, মানুষ, ভালোবাসা, দ্রোহ। রয়েছে সমাজ সচেতনতা, সমাজের নানা বিবর্তন, পরিবর্তনের চিত্রকল্প, রাজনৈতিক চিন্তা, দেশপ্রেম ও জীবনবোধের কাব্যিক শৈল্পিকতা। তিনি সাহিত্যের রথের একজন স্বপ্নসারথী। তিনি ঘুরে বেড়ান অনিন্দ্য সুন্দর কবিতার মানষভ‚মে। কবিতার প্রতিটি পরতে পরতে উন্মুক্ততা ও প্রগতিশীলতার ছাপ পরিলক্ষিত হওয়ায় সিনিয়র কবিদের অন্তরে জায়গা করে নিয়েছেন স্নেহের, বন্ধুত্বের আর তরুণ কবিদের কাছে হয়েছেন পরম শ্রদ্ধার ও ভালোবাসার।
কবি রক্ত দাগ গোপনে পোষেÑফেলেন দীর্ঘশ্বাস। তিলে তিলে ভেসে আসা আর্তনাদ দেখে মস্তিষ্কে ধারণ করেছেন বধ্যভ‚মি। দিগন্তে কানে শোনা সে শোক বার্তা হতেÑসঞ্চয় করেছেন শক্তি। রক্তক্ষরণের তোড়ে প্রতিবাদী মশাল জ্বালিয়ে চেষ্টা করেছেন প্রতিহত করতে অপবিত্র আত্মার ডিগবাজি। কবি বিশ্বাস করেন আবার ফিরে আসবে বসন্ত, ফুলে ফলে ভরে উঠবে চারদিক। পাখিরা গাইবে গান প্রাণ খুলে। দুরন্ত মেঘের পালে বেপরোয়া উড়া সে পাখিটারাও দিগন্ত ঘুরে ফিরে আসবে নক্ষত্রের ছায়াতলে। মগজের কোষে কোষে সাজানো নির্দ্বিধায় ছুঁড়ে ফেলে দিবেন মৃত্যুর বাগান।
কবি বহুবার প্রেমে পড়েছেন। ভালোবাসার মায়ার জালে আটকে গলায় পড়েছেন স্বপ্ন ফুলহার। কবি ভালোবেসে আলোরপথের যাত্রী হয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন রাত্রির গোহায়, এগলি হতেÑওইগলি। এক সময় সুদীর্ঘ পথ একা হেঁটে ক্লান্ত হয়েছেন ঠিকই নির্মোহ সন্ন্যাসে খুঁজেছেন স্বচ্ছ প্রেমের আলো। প্রার্থীব পিঞ্জর ভেঙ্গে হতে চেয়েছেন লালনের পাখি, গালিবি গজল, খৈয়মের মাতাল করা সাকি। কবিকে উদাসী করেছে রমেশের বাঁশি। সাইলেন্ট কিলারের মতো ঐ প্রেমিকার রক্তিম ইচ্ছায় পেয়েছেন রক্তাক্ত হাতের ছাপ, ধারালো খঞ্জর, পড়ে থাকা রক্তাক্ত লাশ। শূন্যতার নিরাক ক্রন্দনে দেখতে হয়েছে ক্রমগত মৃত্যুর আশঙ্কা। শঙ্কিত মনে বিলাপের সুর তুলে চেয়েছেন বাঁচতে। ক্ষুধার্ত দেহে তবু নেননি ঝলসানো মাংসের কাবাব। সৃষ্টির স্রষ্টার কাছে দোয়া করেছেন ভূল দরিয়ায় ছেড়ে দিয়ে মুক্তা হওয়ার স্বপ্ন তিনি কেন দেখালেন। কবিতায় আফসোস করে বলেছেন কবিতার ভরণপোষণ দিতে গিয়ে এত কষ্ট হবে বুঝি নাই রহমান। এ দুনিয়া বড়ই পাপের। কবি উচ্চারণ করেছেন-বঙ্গোপসাগরজোড়া জোয়ারি ঢেউ এর মত উত্তাল সাহসে জেগেছিল যেই বুক, অদ্ভুদ ওপেন হার্ট সার্জারির নিপুন কৌশলে ঝুলিয়েছে দহনের নীল পেন্ডুলাম। একসময় হাজার সূর্যের আলো যার চোখে তারায় মিলেছিলÑসেই দু চোখের কোলে নিজ হাতে মেখে দিয়েছে অশনিপাতের আসমান জমাট মেঘের মেকআপ।
কবির প্রেমিক মনে ভালোবাসার ঝড় তুলেন প্রতিনিয়ত। প্রেমিকার চোখে দেখেছেন কেঁপে ওঠা শিশিরের ঝড়। নিজেকে শুধরাতে কমতি রাখেননি চেষ্টার। কবিতায় উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে কবি বলেছেন-আমাকে মারতে গিয়ে তুমিও মরনি খুব কম, পুনর্জন্ম দিতে গিয়েই আমাকে হত্যা করেছিলে; নিরুপায়ে সেজেছিলে যম। সাপের লেজে কদম ফেলে বহু পথ দিয়েছেন পাড়ি। মৃত্যুভরা জীবনের যাত্রাপথে এগিয়েছেন একা বহুদূর। উপলব্ধি করেছেন লেবুর রসের মত কষা দুঃখগুলো, চিনির দানার মত মিষ্টি সুখ। একটু নেড়ে নেড়ে পাত্র জলে মিশিয়ে বানিয়েছেন জীবন নামের এক সুপেয় শরবত তবুও একরাশ স্বপ্নীল সুন্দরের আশায় নিজের ভেতরে আটকে থাকা হরেক রকম বেদনা কে পেছনে ফেলে গচ্ছিত বেদনাকে শক্তি বানিয়ে ক্ষোভ ঝেড়েছেন কবিতায়, আর তৈরি করেছেন কবিতার চমৎকার চিত্রকল্প। কবির কবিতা যতই পড়ি অনুধাবন করতে পারি ভিতরে থাকা বেদনাকে। প্রেমিকার অস্বচ্ছ ছলনাময়ী প্রেমে মোহগ্রস্ত হয়ে প্রেমিক মন বারবার ছুটে গিয়েছে তার কাছে। পরিণামে পেয়েছে বুক ভরা কষ্ট। বারবার ভেবে ভেবে নিশি রাতে ফুসে উঠেছেন চোখের জোয়ারে।
কবির কবিতায় যেমন পরিলক্ষিত হয়েছে প্রেম, সুখ, দুঃখ আনন্দ বেদনার প্রতিচ্ছবি তেমনিভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে মানুষকে জাগানোর মহামন্ত্র, উদ্যমি শ্লোগান শিরদাঁড়া সোজা করে বেঁচে থাকার সাহস। বলেছেন-পৃথিবী নিজেই তার শ্বাসকষ্টে ফেলে দীর্ঘশ্বাস, ও মানুষ কার কাছে খোঁজো তুমি নিঃশ্বাসে বিশ্বাস! নিজেকে পুড়েছেন বেদনার দহন জ্বালা আগুনে, সে আগুনে পুড়িয়েছেন ফাগুন, হয়ে উঠেছেন খাঁটি সোনা। যেকোনো ফুলের চেয়ে আমি আগুনকে সতর্ক না ভালোবাসি বলেছেন, নিজেকে পোড়াতে তাই ফিরে ফিরে আগুনের কাছাকাছি আসি। কবি আকুল প্রাণে আহবান জানিয়েছেনঃ অপেক্ষায়-উপেক্ষায় তুই তিলে তিলে মারলি যাকে, পথে যদি দেখা ফের তাকেই বাঁধিস বুকে আবেগের ডাকে। আফসোস করে বলেছেন ‘‘পাপবোধ নিজেই নিজেকে; হায় হায় কী ভাবলাম কাকে’’।-সংক্ষেপিত
বিষকন্যা এসেছিল বেহুলার বেশে
প্রকাশনী: র্যামন পাবলিশার্স
প্রচ্ছদঃ উত্তম সেন, মুল্য ৭৫ টাকা
প্রকাশকালঃ একুশে গ্রন্থমেলা-২০০৭ (২য় কাব্যগ্রন্থ)