একটি না হয়ে ওঠা গল্প সন্ধ্যামালতী
তাপস চক্রবর্তী
একটা চিঠির ছেঁড়া অংশ অনেকদিন ধরে জমিয়ে রেখেছি মনের কোণে, চিঠির সেই ছেঁড়া অংশটা বারবার চেতনে অবচেতনে জেগে ওঠে আমার গহনে-নোনাজলে। চিঠির তাৎপর্য তিনটি শব্দ নয়টি অক্ষর। একটা ঝড়ো হাওয়া। কিছু হলুদ পাতা ঝড়ে যাওয়ার বেদনা কিম্বা একটা অস্ফুট বেদনার রোদন। চব্বিশ বছর আগেকার লিখা অতঃপন ফাউন্ডেন্ট পেনের চুপসে উঠা কালি এবং ধোঁয়াশায় মোড়ানো সাদা কাগজ কাঁপ কাঁপা হাতের একটা লেখা। আমার মৃত্যুর জন্য…… এইভাবে আমি আমাদের গল্পটা শুরু করবো কোনদিন ভাবিনি, এইযে আমি কিম্বা আমার মধ্যে যে তাপস বহমান তার কথা বলিনি -কাউকে কোনদিন কিম্বা কোনকালে। কিভাবে বলবো, আমার পরাজয়ের কথা? অথচ জয়ের ধারায় ফিরতেই ইতস্তঃ থেকেছি বারংবার। অথচ আমার অনেকটা সময় গড়িয়ে গেছে সন্ধ্যার আধাঁরে মগ্ন থেকে থেকে। আমার অনেক না বলা কথার পাহাড়ের তলে বসে গুনেছি তারার সংসার। এই যে সন্ধ্যা! বলাকার দল বেঁধে নীড়ে ফেরা। রাতের মুখোমুখি সমস্ত চরাচর। বিদঘুটে আঁধার নেমে আসে মানুষের পায়ের তলে। মানুষ ও কৃত্রিম, কৃত্রিমতায় ডুবে আছে সভ্যতা। জানি আমার সন্ধ্যা মনেই বিহ্বল তানপুরা সুর কিম্বা আমার সন্ধ্যায় না বলা অনেক কথায় চুপ হয়ে আছে ওই তমালের মগডালে। হ্যাঁ আজকের আকাশের মতো সেদিনের আকাশও ছিল মেঘাছন্ন…দুপুরটা ছিল খুব দীর্ঘ যতোটা দীর্ঘ সমুদ্র কিম্বা সূর্য। কিম্বা পাহাড়ের ওপাশটা যেখানে পাতাল কালি উল্টো হয়ে বসে আছে। সদ্য ইন্টার পাশ করা আমরা একদল ছাত্র-ছাত্রী এদিক ওদিক দৌড়াচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্ত্তি হবার জন্য…সেই সুবাধে বন্ধুত্বার খোড়খাতা বৃহৎ হয় কোনটা স্থায়িত্ব আবার কোনটা চোরাবালির টানে হারিয়ে যায় অচেনা গোলিতে। যেখানে অন্ধকার থমকে যায়। হুতোম পেঁচা আতকে উঠে কখনো কখনো-কখনো কখনো শশ্মানের স্তব্ধতায় নড়ে চড়ে বসি নিজের অজান্তে। আয়নায় দাঁড়িয়ে দেখি কালচে পড়া মুখচ্ছবি। এই বুঝি সেই আমি? তখন আমার বয়েস কত হবে বিশ একুশ…উঠতি বয়স…হৈ হুলোড়…বন্ধুপনা…সেই বছরই আমি আনন্দ আর মৌটুসী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্ত্তি হই। আমি বাংলায় মৌটুসী ও আনন্দ জুলোজিতে…লেখাপড়ায় তুখোড় ছিল আনন্দ। যেটা আমার কোনকালেই ছিল না। পিতৃহীন সংসার বেড়ে ওঠা প্রতিটি ছেলেই মেধাবী হয় কিনা জানি না তবে আনন্দ ব্যাপারটা আলাদা। যেমন ঘোর বর্ষায় তমসায় ঢাকা মেঘের পুঞ্জভূত জলের যন্ত্রনায় মেঘ বিহ্বলিত হয় ঠিক তেমনি… আমরা চিরকালেই ছিলাম স্বপ্নবাজ তিনজনের স্বপ্ন ছিল একটা -হাজার কথার ভিড়ে গানও ছিল একটা। আমার বাবা সরকারী চাকরী করতো বাবার পূণর্তা পাইনি যেটা পেয়েছিল মৌটুসী। সেইকথা থাক আনন্দের কথা বলবো বলে কলম ধরেছি, আনন্দ। এই গল্পের নায়ক। আমাদের দু ‘ গাঁ পরেই তার আবাস। বিখ্যাত সেনগুপ্ত পরিবারে তার জন্ম। আনন্দময় সেনগুপ্ত। বাবা নিখিলরজ্ঞন মুক্তিযুদ্ধে শহিদ। তিনভাই বোনের সংসার… আনন্দ সংসারের বড়। দুবেলা দুটো টিউশানে আনন্দের পড়ার খরচ চলে। মা স্কুল টিচার। আমার যখন নতুন পোষাক হতো তখন আনন্দের সেই পুরোন টি শার্ট মাঝে মাঝে আমি আর মৌটুসী মিলে নতুন কিছু দিলে সে লজ্জিত হতো…সহজ কিছু নিতে চাইতো না। সেই থাক নিজেকে মহৎ কিম্বা বৃহৎ ভাবতে কুন্ঠিত আমি। তবে হ্যাঁ এই যে আজকের শ্রাবণের সন্ধ্যা আবীরের আলপনা…সবি মনে পড়া স্মৃতি, এই স্মৃতির আলপনায় আনন্দ যে কতোটুকু বিস্মৃত সেই কথা সময় জানান দেয় গহ্বরে নোনাজলে দুঃখই যে আনন্দ তাই বলবো। মৌটুসী যে মনে প্রাণে আনন্দকে চাইতো তার বহিঃপ্রকাশ কয়েকবার লক্ষ্য করেছি কিন্তু আনন্দ তার দৈন্যতার পাহাড়ের প্রাদদেশে মৌটুসীকে রেখে বারবার উপেক্ষায় করেছে তাও দেখেছি আমি দেখেছি… আমরা সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল সবে মাত্র শেষ করেছি বিশাল ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরবো ফিরবো করছি এমনি একিদন হোষ্টল কড়িডোরে আনন্দের বিষন্ন মুখ দেখে থমকে দাঁড়ালাম বললাম কি রে দোস্ত! সমস্যা কি? কিছুই না বলে অশ্বত্থের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। বুঝলাম সমস্যা অন্যখানে যেখানে আমার প্রবেশাধিকার নিষেধ। হাত ধরে কেন্টিনে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম দুপুরের খাওয়া হয়েছে? আনন্দ আমার কথা কেড়ে নিয়ে বিদ্যুতের গতিতেই বলে উঠলো কি পেয়েছিস? আমি কি তোদের হাতের পুতুল যখন ইচ্ছে শোকেচে রাখবি আবার অপ্রয়োজনে ফেলে দিবি কি পেয়ছিস? আমি শান্ত হয়ে বললাম ব্যাপারখান খুলে বলতো! আনন্দ বললো খুলে বললে কি তুই আমাকে স্বর্গে নিয়ে যাবি! সোজা সাপ্টা উত্তর চেষ্টা করবো। এখন কি খাবি বল? চা দুপুরের ভাত খেয়েছিস? না তো ভাত না খেয়ে চা খেতে চাইছিস কেন? আমার ইচ্ছে। বেশ খা। কেন্টিন বয়কে দুটো চা আনতে বলবো বলে উঠছি এমন সময় মৌটুসীর আগমন। আমি বললাম কি রে আজ সূর্য কোন্ পানে উঠলো সবার দেখা মেলে এক গগনতলে! ঠাট্টা রাখ কেন? বোস বলছি। কাল সকালেই বাড়ি ফিরে যাবো। আর ফিরবো কিনা জানিনা তবে,,,,, কথা কেড়ে নিয়ে আনন্দ বললো তুই বাড়ি যা ফিরে আয় বা নাইবা আয় তাতে কার কি হবে? কিছু হবে না! ওসব আবেগী সংলাপ রাখ। বুঝলাম জল অনেকদূর অবধি গড়িয়েছে আমার সরল উক্তি সমস্যা দেখছি তোদের দুজনের বুঝে শুনে সমাধান কর সমাধান হবে না সোজা উত্তর মৌটুসীর কেন? আমি জানতে চাইলাম। তোর বন্ধুকে জিজ্ঞেস কর? কিসের মোহে আামাকে ভুল বুঝলো? আমি আবারও বলছি একজন আরেকজনকে তার ভালবাসা জানাতে পারে এটা কোন দোষের নয়। সেইক্ষেত্রে একজন আরেকজনেরটা গ্রহন করতে পারে কিম্বা নাও পারে কিন্তু আমিতো গ্রহন করিনি। আমি শুধু ওই শুয়োরটা কে ভালোবেসেছি ব্যাস এই কাহিনি? আমি বললাম। তারপর সেই দুপুর গড়িয়ে -বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা তারপর রাতের শহরে হলুদবাতি তবুও খুঁজি তারা ভরা আকাশ,নিস্তব্ধতা নেমে আসে পহাড়ের কোলে। তারপর বিশাল ছুটি। সবাই সবার মতো করে বাড়ি ফিরে গেছে। মৌটুসী শহরে আনন্দের ফেরা হয়নি কারণ টিউশানে ছুটি নেই আসছে ডিসেম্বরে দুটো ছাত্রের পরীক্ষা। আমার কোন টিউশান নেই তাই আমি বেড়াতে বের হলাম। প্রথমে সিলেট বাবার চাকরীর স্থলে তারপর মামার বাড়ি। ছুটি কাটিয়ে ফেরার দশ দুই বাদে আমাদের রেজাল্ট দিলো। মৌটুসী ফাস্ট ক্লাস। আমি বরাবরের মতোই পঙ্গু লঙিতে পারি না গিরী মানে তথৈবচ আর যে বিষয়টা আমাকে থমকে দিলো সেটা হলো আনন্দের রেজাল্ট। যে জীবনে সেকেন্ড হতে জানতো না সে কিনা তিন বিষয়ে ফেল!
এই নিয়ে প্রচুর কথাবার্তা, মুখরোচক আমস্বত্তের ব্যঞ্জন কিম্বা কর্ণমূল বির্দন করা কিছু শব্দ আমি শুনেছি। তাই বলে আনন্দের মতো গোবেচারার এতো বঞ্চনার শিকার? শুনেছি অনাথের ঈশ্বর থাকেন পাহারায় কিন্তু আনন্দের বেলায় ঈশ্বর কোথায় গেলেন? বুনোরিড়ালের শিকার ধরার দৃর্শ্য আমার দেখার সৌভাগ্য হয়নি অথচ কুরূচিপূর্ণ মানুষের শিকার ধরার কথা শুনে আমি শিহরিত হই। মাঝে মাঝে সন্ধ্যার আকাশের পানে তাকিয়ে ভাবি সত্যিই কি আমি মানুষ নাকি বুনো শুয়োর। থাক সেই কথা। গল্পে ফিরি—কারণ গল্পই তো জীবন! রেজাল্টের কারণ জানতে চেয়ে প্রভোষ্টকে দেওয়া চিঠির উত্তর পাওয়া যায়নি যথারীতি আমরা থার্ড ইয়ারে এবং আনন্দ সেকেন্ড ইয়ারে মনের মধ্যে একটা হীনমন্যতা কাজ করছিলো। আমাদের পাশ কাটিয়ে চলাচল করতো। এই নিয়ে অনেকবার বসা হয়েছে কিন্তু যে কাঁঠাল তো সে তেল। আজকাল মৌটুসী কেমন যেন পাল্টে গেছে’। জিজ্ঞেস করলে কথা পাল্টিয়ে অন্য প্রসঙ্গ আনে কিম্বা কথার পিঠে কথা এনে বলতো কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। এই কথার গুঢ়তত্ত্ব বুঝিনি তাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেছি থার্ড ইয়ারেও মৌটুসী একিই রেজাল্ট মেধা তালিকার শীর্ষে এইবার কোন রকমে পাশ করলো আনন্দ। কিন্তু মৌটুসীর অবজ্ঞা অবহেলায় নিশ্চুপ হয়ে আসে শ্রাবণের প্রতিটি সন্ধ্যা। তারপর রচিত হয় অন্য ইতিহাস যেমন মৌটুসী এখন কলেজে পড়ায়। তুখোড় স্বামী সোহাগী। আমি সংসার সমরাঙ্গনের বীরযোদ্ধা। আর আনন্দ? সেই চিঠি! গুমরে উঠে উটপাখির ঠোঁট। কদমফুল আর বিকোশিত হয় না আজকাল। শয্যায় কলুষিত আমাদের শিক্ষা। কতিপয় কোমল নরমাংসাশী শিক্ষক আর কতিপয় স্বার্থপর… নিজেকে ঘুছিয়ে নেওয়ার মন মানসিকতার প্রাণীদের কি ভৎসনা থাকে তাই বলবার ভাষা খুঁজি শ্রাবণের এই সন্ধ্যায় সন্ধ্যামালতীর সুবাসে…
লেখক: কবি, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক